Connect with us

গুণীজন

জিনিয়াসদের ‘ব্যাকরণ’ : লেখক সুশান্ত পাল

সুশান্ত পাল
লেখক, বক্তা
প্রথম শ্রেণির গ্যাজেটেড সরকারী কর্মকর্তা

এ জগতে যত মহৎ সৃষ্টি ও কাজ হয়েছে, তার বেশিরভাগই হয়েছে কোনো না কোনো পাগলাটে জিনিয়াসের হাত ধরে। জিনিয়াস হতে কী লাগে? চারবেলা দুধ-ডিম আর পুষ্টিকর খাবার? না না, ওসব কিছুই লাগে না। বেশিরভাগ জিনিয়াসই জন্মগতভাবেই জিনিয়াস। ক্রমাগত সাধনায় ওদের এই আশ্চর্য দিকটা আরও শাণিত ও পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।
খেয়াল করে দেখবেন, আপনার অফিসেই আপনার এক কলিগ আট ঘণ্টার কাজ আট ঘণ্টা ধরেই করে যাচ্ছেন কোনও ফাঁকি দেওয়া ছাড়া। আবার ঠিক একই কাজ অন্য এক কলিগ হয়তো দুই-আড়াই ঘণ্টায় চমৎকারভাবে শেষ করে ফেলছেন। বাকি সময়টাতে তিনি নিজের আনন্দের কাজগুলো করছেন। আবার বস যদি একটু কাজপাগল হন, মানে বসে-থাকাটা পছন্দ না করেন, তবে তিনি কম সময়ে কাজ সম্পন্ন করা সেই ব্যক্তির ঘাড়ে তুলে দেন আরও কিছু কাজের লিস্ট। হয়তো সেই বাড়তি কাজও ওই জিনিয়াস কর্মী অপেক্ষাকৃত কম সময়ে শেষ করে ফেলেন। বাকিটা সময় বের করে নেন নিজের আনন্দের কাজগুলো করতে। হ্যাঁ, তিনি যেকোনও উপায়েই কিছু অবসর সময় বের করে নেবেনই, এবং সেটি অবশ্যই অবশ্যই তাঁর কাজে ফাঁকি না দিয়ে। অফিসের কাজটা ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন করেন একটু কম সময়ে। জিনিয়াসরা তাঁদের পছন্দের কাজের জন্য সময় বের করে নেনই। দরকার হলে অন্যরা যে সময়ে ঘুমায়, পরিবারের সাথে সময় দেয়, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারে, ঘোরাঘুরি করে এদিক ওদিক, সে সময়ে তাঁরা নিরলস খেটে যান তাঁদের প্যাশনের জায়গায় অবগাহন করতে। এতে করে কী বোঝা গেল? একটু বুঝিয়ে বলি। যদি চব্বিশ ঘণ্টাই খাটুনি করে জিনিয়াস হওয়া যেত, তবে অনেক জিনিয়াস আমরা রাস্তাঘাটেই দেখতে পেতাম। সামর্থ্যের কিছু ব্যাপারও আছে এখানে। সবাই চাইলেই সব কাজ করতে পারে না। একটি হরিণ শিকার করে খেতে বাঘের যত সময় লাগে, একই হরিণটা শিকার করতে গাধার লাগবে কয়েক দিন বা কয়েক মাস, যদি সে আদৌ হরিণটা শিকার করতে পারে আরকি! জগতে সবারই ব্রেইনের গঠন মোটামুটি একই রকম হলেও, সবার প্রতিভার ধরন আর ক্ষেত্র একই রকম হয় না। একজন জিনিয়াস ফটোগ্রাফারের একটি ক্লিক অন্য একজন দক্ষ ফটোগ্রাফারের ক্লিকের চাইতে অনেক অনেক আলাদা হয়। ক্যামেরা থাকলেই যদি ফটোগ্রাফার হওয়া যেত, তবে পৃথিবীর পথেঘাটে ফটোগ্রাফাররা ঘুরে বেড়াত। একটি চমৎকার দৃশ্যকে ছবিতে ধারণ করতে একজন জিনিয়াস ফটোগ্রাফারের যে সময়টা লাগবে, সেই একই দৃশ্য তুলে ধরতে সাধারণ মানের কারও সময় লাগবে তার শতগুণ বেশি। এমনকি ওই সময়টা দিলেও কাজটি করতে তিনি ব্যর্থও হতে পারেন! একজন পাবলো পিকাসো তাঁর তুলির কয়েক আঁচড়ে ছবিকে জীবন্ত করে তুলতে যতক্ষণ সময় খরচ করবেন, সেই একই কাজটি করতে আমার বা আপনার মতো কাউকে সাধনা করতে হবে কয়েক যুগ কিংবা কয়েক জন্ম! জিনিয়াস তৈরি করা যায় না, জিনিয়াসরা জন্ম নেয়। কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির কথা ভাবি, চলুন। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতার কথা ভাবা যাক। বাংলা সাহিত্যের এই বিখ্যাত কবিতাটা লেখা হয়েছিল বনলতা সেন নামী নিতান্ত সাধারণ এক রাজবন্দিকে মাথায় রেখে। তিনি ১৯৩২ কিংবা ১৯৩৩ সালে রাজশাহীর জেলে নিবর্তক আইনে বন্দি ছিলেন। রাজশাহী থেকে কাছেই অবস্থিত নাটোরের নামটা ব্যবহার করে তিনি লিখে ফেললেন এই জনপ্রিয়তম কবিতাটি। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে আমরাও তো কত মানুষের কথা শুনি, নাম জানি। তবু কি কারও কথা ভেবে ওরকম কিছু লিখতে পারব কয়েক যুগ চেষ্টা করেও? জিনিয়াস আর সাধারণের মধ্যে আকাশ-পাতাল দূরত্ব আছে। আমাদের অনেকের চোখে এসব অহংকার। আমাদের চোখে যা অহংকার, ওদের কাছে সেটাই স্বাভাবিক জীবনাচরণ। ওদেরকে ওদের মতোই থাকতে দেওয়া উচিত।
জগতখ্যাত ভাস্কর রোঁদ্যা। পাথর খোদাই করে মূর্তি গড়েন। পাথরের যে টুকরোগুলো অন্য দশজন সাধারণ লোকের চোখে কেবলই অপ্রয়োজনীয় পাথর, সেগুলো একজন রোঁদ্যার কাছে ভাস্কর্যের মহামূল্যবান উপাদান বা খনি। পাথরের গা কেটে কেটে তিনি তৈরি করেন অনন্যসাধারণ সব ভাস্কর্য। নগণ্য পাথরের মধ্যে লুকিয়ে আছে শিল্পের এমন একটি সম্পদ, যা দেখতে চাইলে একজন রোঁদ্যার চোখ থাকতে হয়। পাথর তো সবাই-ই দেখে, পাথরের ভেতরের সৃষ্টিটাকে রোঁদ্যার মতো কে-ইবা দেখতে পায়? কয়জনই-বা একজন রোঁদ্যা হতে পারে, এমনকি নিরলস সাধনা করলেও? মেধাবী ভাস্কর হয়তো অসীম চেষ্টায় হওয়া সম্ভব, তবে একজন রোঁদ্যা হতে চাইলে জিনিয়াস হতে হয়। জিনিয়াস আর মেধাবী, এই দুইয়ের পার্থক্যটা ঠিক এই জায়গায়।

মরীচিকা ওয়েব সিরিজ রিভিউ | সুমন বৈদ্য

More in গুণীজন